Clash of Civilizations বা সভ্যতার সংঘাত হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এর একটি থিসিস বা তত্ত্ব, যেটা বলে যে স্নায়ু যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সংঘাত বা Conflict হবে মানুষের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় এর ভিত্তিতে। তত্ত্বটির জনক মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন (১৯২৭ - ২০০৮) বলেছেন, “ভবিষ্যৎ যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে সংস্কৃতিতে-সংস্কৃতিতে; দেশে-দেশে নয়।” প্রফেসর হান্টিংটন ১৯৯২ সালে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটে দেওয়া এক লেকচারে প্রথম এই তত্ত্বের প্রচার করেন। পরবর্তীতে তত্ত্বটিকে আরও সমৃদ্ধ করে ১৯৯৩ সালে তিনি Foreign Affairs জার্নালে “The Clash of Civilizations?” শিরোনামে আর্টিকেল-আকারে প্রকাশ করেন। আরও পরে ১৯৯৬ সালে তিনি The Clash of Civilizations and the Remaking of the World Order শিরোনামে বই আকারেও তত্ত্বটিকে লিপিবদ্ধ করেন।
প্রেক্ষাপট
- স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব-রাজনীতিতে জাতিসমূহের জন্য মানবাধিকার (Human Rights), উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy) এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি (Free Market Capitalism) - এই তিন মতবাদ ভিন্ন অন্য কোন মতবাদ জায়গা করে নিতে পারেনি
- তাই হান্টিংটন এর প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা (Francis Fukuyama) সহ বেশ কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করতে শুরু করলেন যে বিশ্ব এক “end of history” বা হেগেলিয়ান সাম্যাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে
- সেসময় প্রফেসর হান্টিংটন এই তত্ত্ব দেন যে, ভবিষ্যৎ সংঘাত ও সংঘর্ষ হবে সাংস্কৃতিক বিষয়াবলী নিয়ে
মূলকথা
-
স্নায়ুযুদ্ধ পূর্ববর্তী বিশ্বে অ-পশ্চিমা বিশ্ব যেমন পশ্চিমাদের প্রাধান্যে অ-গুরুত্বপূর্ণ ছিল, হান্টিংটন এর মতে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে
-
সাংস্কৃতিক (ও ধর্মীয়) আচার এর পার্থক্যের ভিত্তিতে তিনি বিশ্বকে ৯ (নয়) টি পৃথক “সভ্যতা” তে বিভক্ত করেছেন
- Western Civilization (পশ্চিমা সভ্যতা)
- Orthodox Civilization (চিরায়ত খ্রিস্টান সভ্যতা)
- Islamic Civilization (ইসলামী সভ্যতা)
- Buddhist Civilization (বৌদ্ধ সভ্যতা)
- Hindu Civilization (হিন্দু সভ্যতা)
- African Civilization (আফ্রিকান সভ্যতা)
- Latin American Civilization (ল্যাটিন আমেরিকান সভ্যতা)
- Sinic Civilization (চৈনিক সভ্যতা) ও
- Japanese Civilization (জাপানি সভ্যতা)
-
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পর চেচনিয়ার যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল এই সভ্যতার সংঘাত ভিত্তিক অর্থাৎ আন্তঃসাংস্কৃতিক
-
গণতন্ত্র, উদারনীতি ইত্যাদি পশ্চিমা মূল্যবোধকে পশ্চিম “ইউনিভার্সাল মূল্যবোধ” মনে করে থাকে, হান্টিংটন সেটার বিরোধিতা করেছেন
-
হান্টিংটন তার তত্ত্বে বলেছেন, দিনে দিনে পশ্চিম থেকে সর্বময়ী ক্ষমতা অন্যান্য সভ্যতার দিকে ধাবিত হবে। এক্ষেত্রে তিনি দুইটি বিশেষ অ-পশ্চিম সভ্যতাকে চিহ্নিত করেছেনঃ
1. চৈনিক সভ্যতা
-
দ্রুত অর্থনীতিক উন্নতি চীনকে চৈনিক সভ্যতার একচ্ছত্র আধিপত্যের (Hegemony) দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে
-
আঞ্চলিক অন্যান্য শক্তি যেমন, দুই কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম ইত্যাদি - চীনের চাহিদানুযায়ী নিজেদের পরিচালিত করবে; কেননা পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতিতে আধিপত্যপরম্পরাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা (hierarchical societal structure) কনফুসিয়ান আমল থেকেই একেবারে গভীরে প্রোথিত
2. ইসলামী সভ্যতা
-
ইসলামী সভ্যতার অন্তর্গত দেশগুলোতে গত শতকে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে; সেকারণে এই দেশগুলো এখনো পর্যন্ত অস্থিতিশীল
-
এছাড়াও সেখানে মৌলবাদ ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে
-
ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে এই সভ্যতার বিকাশে কিছু ইসলামী পুনরুত্থান হওয়ার কথা হান্টিংটন বলেছেন। তিনি মনে করেন ১৯৭৯ এর ইরানি বিপ্লব এবং প্রথম গালফ যুদ্ধ সেই পুনরুত্থানের অংশ
-
হান্টিংটনের মতে, ইসলামী সভ্যতার সীমানা অনেক “রক্তক্ষয়ী” (bloody); কেননা এই সভ্যতা বহু সভ্যতার সাথে সীমানা রক্ষা করে যথা - উত্তরে চিরায়ত খ্রিস্টান সভ্যতা (Orthodox), দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আফ্রিকান সভ্যতা, পশ্চিমে পশ্চিমা সভ্যতা ও পূর্বে হিন্দু ও চৈনিক সভ্যতা
-
হান্টিংটন মনে করেন নিকট ভবিষ্যতে ইসলামী সভ্যতা চৈনিক সভ্যতার মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে কেননা এই দুই সভ্যতাই পশ্চিমা ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে নতুন বিশ্ব-সংস্কৃতির আবির্ভাব করাতে চাইছে
-
যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন-ব্যবহার ও বিপণন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে এই দুই সভ্যতার অবস্থান কাছাকাছি এবং তা পশ্চিমা মূল্যবোধের বিপরীত। সুতরাং এখানে সংঘাত অনিবার্য
-
রাশিয়া, জাপান ও ভারত কে হান্টিংটন বলেছেন “সুইং স্টেট” (Swing State); কারণ এঁরা আসন্ন চৈনিক-ইসলামী বনাম পশ্চিমা সংঘাতে যেকোনো পন্থী হতে পারে। রাশিয়া যেমন তার দক্ষিণ সীমান্তে মুসলিম অঙ্গরাজ্যগুলোতে নিপীড়ন করে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সংঘর্ষেও লিপ্ত, তেমনি সে ইরান এর সাথেও মিত্রতায় আবদ্ধ
কেন সভ্যতা সংঘাতে জড়াবে
সভ্যতায় সভ্যতায় কেন হানাহানি ও সংঘাত হবে হান্টিংটন তাঁর এই তত্ত্বে সেটা নিয়ে নিম্নোক্ত ছয়টি কারণ দেখিয়েছেনঃ
- সভ্যতাগুলোর মধ্যে - ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, কৃষ্টি, কালচার ও ধর্মীয় আচার-ব্যবহার ইত্যাদির পার্থক্য অত্যন্ত প্রকট। এবং এই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আচার-সংস্কৃতি একদিনের ফসল নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তাই খুব সহজে, চাইলেও এই পার্থক্য দ্রুত দূরীভূতকরণ সম্ভবপর নয়। এই পার্থক্যই হবে সভ্যতার সংঘাতের মূলগত ভিত্তি।
- প্রাযুক্তিক উৎকর্ষে পৃথিবী দিনে দিনে আরও ছোট হয়ে আসছে, যার দরুন আন্তঃসভ্যতা যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। তার ফলশ্রুতিতে সভ্যতাগুলো নিজের মধ্যকার সামঞ্জস্য (Similarities) এবং বৈসাদৃশ্য (Differences) এর ব্যাপারে অতীতের চেয়ে আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। তাই মত-পার্থক্যগুলো আরও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
- অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে পূর্বের ন্যায় আঞ্চলিক পরিচয় (local identity) আর এখন এতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে না; সেটার জায়গা দখল করেছে ধর্মীয় পরিচয় (religious identity)। ফলে জাতীয়তা বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের চেয়ে দিনে দিনে জনমানসে সভ্যতার পরিচয় ব্যপকতর হয়ে উঠছে।
- পশ্চিমা বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতা সভ্যতার সংঘাতের পেছনে একটি বড় কারণ। কেননা, আধিপত্যের শিখরে পশ্চিমের অবস্থান ও তার একগুঁয়েভাবে গুটিকয়েক মূলনীতিকে বৈশ্বিক মূলনীতি প্রচার, অ-পশ্চিমে আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তুলছে।
- সাংস্কৃতিক ভিন্নমত এর ক্ষেত্রে সমঝোতা, রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক ভিন্নমতের সমঝোতার চাইতে কঠিন।
- আঞ্চলিক অর্থনীতিক জোটগুলির প্রকটতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণত একই সভ্যতাভুক্ত দেশগুলির পাশাপাশি অবস্থান হয়, ফলে আঞ্চলিক অর্থনীতিক জোট শক্তিশালী হলে সভ্যতার সংঘাত অনিবার্য হবে।
সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের সমালোচনাঃ
- হান্টিংটনের তত্ত্বের সমালোচনা করে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন যে বেশিরভাগ সভ্যতার ক্ষেত্রেই অ-সমসত্ততা (inhomogeneity) এবং বৈচিত্র্য এখন অতিপরিচিত। পশ্চিমের গণতন্ত্র, উদারনীতি ইত্যাদি মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প-বিপ্লব, রেনেসাঁ ইত্যাদি বৈশ্বিক ঘটনাবলির মাধ্যমে - একদিনে নয়। কারণ পশ্চিম নিজেও সমসত্ত নয়, তাই এই সময়টা নিতে হয়েছে। তাই অমর্ত্য সেন মনে করেন, বিশ্বের অ-সমসত্ত সকল সভ্যতার পার্থক্যের দরুন “সংঘাত” খুব সহজ বা দ্রুত কিছু নয়।
- বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্য-সমালোচক এডওয়ার্ড সাইদ হান্টিংটনের তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, হান্টিংটন যেভাবে সোজা সাপটা ভাবে সভ্যতার সীমানা ও পরিধি নিশ্চিত করেছেন তা ভ্রান্তিমূলক, কেননা এইভাবে সভ্যতার শ্রেণিবিভাগ করলে সভ্যতাগুলোর নিজেদের মধ্যকার গতিশীল সম্পর্ক অনুল্লেখিত থেকে যায়। তিনি এই তত্ত্বকে বর্ণবাদী বা racist আখ্যা দিয়েছেন।
- ভাষাতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী নো’ম চমস্কি এই তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে এই তত্ত্ব আসলে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে ইরাক, ইরান ও সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়ার খোঁড়া চেষ্টা।
- ইসরায়েলি গবেষক ও ইতিহাসবিদ ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি তাঁর 21 Lessons for 21st Century বইতে clash of civilzations তত্ত্বকে বিভ্রান্তিমূলক বা misleading বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন Islamic Civilizations থেকে হওয়া মৌলবাদী আগ্রাসন শুধুমাত্র পশ্চিমের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধেও বটে।